যখন মৃত্যু দরজায় কড়া নাড়ে: মানুষের অনুতাপ, আল্লাহর অনুগ্রহ ও ভুলে যাওয়ার নিষ্ঠুরতা

হাসপাতালের নিঃশব্দ রাত। মনিটরের টিকটিক শব্দ, কাঁচের ওপারে অপেক্ষা। সেই মুহূর্তে মানুষ কাঁদে— “হে আল্লাহ, আমাকে আরেকটু সময় দিন…” কিন্তু দরজা পেরিয়ে সুস্থতার আলোয় ফিরে এলে কেন সেই কান্না থেমে যায়, প্রতিজ্ঞাগুলো হারিয়ে যায়?

যখন মানুষ কাঁদে, আর যখন সে ভুলে যায়

আইসিইউর ঠান্ডা বাতাসে মানুষ বুঝে যায়— সে কতটা ভঙ্গুর। অহংকার থাকে না, কথা কমে যায়, দুহাত জোড় হয়ে যায়। কিন্তু সুস্থতার প্রথম ভোরেই যেন অনুতাপের পাতাগুলো উড়ে যায়।

﴿فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُ ضُرَّهُ مَرَّ كَأَنْ لَمْ يَدْعُنَا﴾

“যখন আমরা তার কষ্ট দূর করি, তখন সে এমনভাবে চলে যায় যেন সে কখনো আমাদের ডাকেনি।” — সূরা ইউনুস: ১২

এটাই মানুষের কঠিন বাস্তবতা— বিপদে ডাক, স্বাচ্ছন্দ্যে ভোল। এই ভুলে যাওয়ার অসুখই আমাদের হৃদয়কে শুষ্ক করে দেয়।

আমরা আসলে কতটা নিরাপদ?

আপনি কি নিশ্চিত— ছাদের পলেস্তারা আজ রাতেই পড়বে না? রাস্তায় ব্রেক-ফেল করা একটি গাড়ি আপনার দিকে ছুটে আসবে না? সত্যি কথা— আমরা কাল বাঁচব কি না, জানি না।

﴿وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ﴾

“কোনো প্রাণই জানে না সে আগামীকাল কী উপার্জন করবে, আর জানে না কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে।” — সূরা লুকমান: ৩৪

মৃত্যু সামনের দরজায় নয়, অনেক সময় পেছনের জানালায় কড়া নাড়ে। আর তখন প্রস্তুতির সময় থাকে না।

আল্লাহর অনুগ্রহের সমুদ্র— আমরা কেবল তীরে দাঁড়াই

আমাদের প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি নিরাপত্তা, প্রতিটি রুটির কণা— সবই আল্লাহর দান। আমরা ঘুমাই— আর তিনি পাহারা দেন। আমরা ভুল করি— তিনি ঢেকে দেন।

﴿وَمَا بِكُم مِّن نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ﴾

“তোমাদের যা কিছু অনুগ্রহ আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই।” — সূরা নাহল: ৫৩

﴿فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ﴾

“তাহলে তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?” — সূরা আর-রহমান

তবুও মানুষ বলে— “আমিই করেছি, আমারই কৃতিত্ব।” কুরআন আমাদের মনে করায়—

﴿إِنَّ الإِنسَانَ لِرَبِّهِ لَكَنُودٌ﴾

“নিশ্চয়ই মানুষ তার রবের প্রতি অতি অকৃতজ্ঞ।” — সূরা আদিয়াত: ৬

ইতিহাসের আয়না: প্রস্থানই চূড়ান্ত সত্য

রাজাদের শোভাযাত্রায় শহর থেমে যেত। এখন তারা কবরের শান্ত মাটিতে। আজ যাদের নামেই জনতা সারি দিয়ে দাঁড়ায়— কাল তাদেরও ঠিকানায় ধুলো জমবে।

রাসূল ﷺ বলেছেন: “দুনিয়ায় তুমি একজন অপরিচিত বা পথিকের মতো থাক।” — সহিহ বুখারি ৬৪১৬

আমরাও পথিক। ফানুসের মতো আলোর সময়টুকুই আমাদের। প্রশ্ন— আমরা কি ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি?

ইনসাফের মৃত্যু, মানুষের হার

ব্যবসায় প্রতারণা, রাজনীতিতে স্বার্থ, পরিবারে অবিচার— ন্যায় যেন বিরল। অথচ আদেশ স্পষ্ট—

﴿إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ النَّاسِ أَن تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ﴾

“অমানত হকদারের কাছে পৌঁছে দাও এবং মানুষের মাঝে বিচার করলে ন্যায়বিচার কর।” — সূরা নিসা: ৫৮

ইনসাফ ফিরে আসে যখন হৃদয়ে তাকওয়া জাগে, আর তাকওয়া জাগে কৃতজ্ঞতা ও তওবার চর্চা থেকে।

তওবার দরজা খোলা— এখনই ফিরে আসুন

বিপদের সময়ের কান্নাকে প্রতিদিনের কাজে পরিণত করুন: নামাজ কায়েম, হারাম থেকে বাঁচা, মানুষের হক আদায়, দানের অভ্যাস, কুরআন পড়া।

রাসূল ﷺ বলেছেন: “আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবা গ্রহণ করতে থাকেন, যতক্ষণ না প্রাণ কণ্ঠে পৌঁছে যায়।” — তিরমিজি

আজই শুরু করুন— কৃতজ্ঞতার ডায়েরি, প্রতিদিনের ইস্তেগফার, এবং ইনসাফের সিদ্ধান্ত। কারণ কাল নামে কোনো দিন আমাদের হাতে নিশ্চিত নয়।

শেষ কথা: ভুলে যাওয়ার অসুখ থেকে মুক্তির প্রার্থনা

হে আল্লাহ, বিপদে যেমন আপনাকে ডাকি, সুস্থতায়ও যেন আপনাকেই স্মরণ করি। আমাদের হৃদয়কে নরম করে দিন, ইনসাফের পথে দৃঢ় করুন, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করুন।

﴿رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا﴾

“হে আমাদের রব, আপনি হেদায়াত দেওয়ার পর আমাদের হৃদয়কে বেঁকিয়ে দেবেন না।” — সূরা আলে ইমরান: ৮

Tags: মানুষের অনুতাপ, আল্লাহর অনুগ্রহ, মৃত্যুর শিক্ষা, কুরআন, হাদিস, ইনসাফ, তওবা, আখেরাত